মৌলিক সমস্যা অমীমাংসিত রেখে যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্য যুদ্ধের বিরতি

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক সমঝোতা আপাতদৃষ্টিতে বৈশ্বিক বাজারে স্বস্তি ফিরিয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই বাণিজ্য যুদ্ধের ‘বিরতি’ মূল সব সমস্যার কোনো সমাধান আনতে পারেনি, আগের মতোই তা অমীমংসিত রয়ে গেছে।

Oct 28, 2025 - 00:23
মৌলিক সমস্যা অমীমাংসিত রেখে যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্য যুদ্ধের বিরতি
চীনের গুয়াংজু শহরের নানশা বন্দরে পণ্য পরিবহন। ছবি: ব্লুমবার্গ

যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক সমঝোতা আপাতদৃষ্টিতে বৈশ্বিক বাজারে স্বস্তি ফিরিয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই বাণিজ্য যুদ্ধেরবিরতিমূল সব সমস্যার কোনো সমাধান আনতে পারেনি, আগের মতোই তা অমীমংসিত রয়ে গেছে।

এই সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠকের আগে দুই দেশের আলোচকেরা বেশ কিছুসহজ জয়তুলে এনেছেন। চীনের সঙ্গে চুক্তি নিয়েসত্যিই ভালো বোধ’ করার কথা জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পও। চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের সর্বশেষ ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি প্রত্যাহার করতে পারে, বিনিময়ে চীন আবারও মার্কিন সয়াবিন কেনা শুরু করবে এবং বিরল খনিজ রপ্তানিতেও কড়াকড়ি শিথিল করবে।

এই ঘোষণার পর বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে উত্থান দেখা দেয়। এমএসসিআই গ্লোবাল ইনডেক্স রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। তবে বিশ্লেষকদের সতর্কর্তা চুক্তি মূল সমস্যাগুলোর কোনোটির সমাধান আনতে পারেনি।

চীনের চিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সান চেংহাও বলেন, ‘সহজ সাফল্য আগে পেলে কঠিন কাজগুলো আরও জটিল হয়ে যায়।তাঁর মতে, ‘বড় চুক্তিকরতে হলে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি, প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা জাতীয় নিরাপত্তাএই তিনটি ক্ষেত্রে গভীর মতবিরোধ মিটিয়ে ফেলা উচিত, কিন্তু তা করা হয়নি। তিনি ধারণা করছেন, আগামী কয়েক বছর বড় কোনো চুক্তির বদলে খাতভিত্তিক ছোট ছোট সমঝোতাই দেখা যাবে।

মার্কিন ট্রেজারি সচিব স্কট বেসেন্ট সাম্প্রতিক আলোচনায় চীনকে ভোক্তা ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বেইজিং তার বদলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত উৎপাদন প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরতার রূপরেখা প্রকাশ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার বিপরীত।

এশিয়া সফরের শুরুতেই ট্রাম্প থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেছেন। এ সব ‍চুত্তির বেশিরভাগই চীনের প্রভাব মোকাবিলায় লক্ষ্যভিত্তিক। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ট্রাম্পের কৌশলগতভাবে মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে পাশে টেনে নেওয়ার প্রচেষ্টা।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি চীন সফরে যেতে চান এবং শি জিনপিংকেও ওয়াশিংটনকিংবা ফ্লোরিডার তার ব্যক্তিগত ক্লাব মার--লাগোয় আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। ২০২৬ সালে চীন এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশন (এপেক) সম্মেলনের আয়োজন করবে, আর যুক্তরাষ্ট্র আয়োজন করবে জি-২০ সম্মেলনের। ফলে দুই দেশের নেতার ভবিষ্যৎ সফর সম্ভাবনা উভয়পক্ষের জন্যই উন্মুক্ত।

২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত উচ্চ শুল্কের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। সাম্প্রতিক আলোচনার পর চীন বিরল খনিজ রপ্তানিতে সাময়িক শিথিলতার ইঙ্গিত দিলেও, যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নীতিতে কোনো ছাড় দেখা যায়নি। বেসেন্ট জানিয়েছেন, চীন তাদের রেয়ার আর্থ রপ্তানির সীমাবদ্ধতা এক বছর সময় নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করবে। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের ধারণা, চীন কখনোই এই খাতে তার নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করবে না। অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক ডেক্সটার রবার্টস বলেন, ‘রেয়ার আর্থে নিজেদের প্রভাব ছেড়ে দেওয়া চীনের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে।

ফেন্টানিল ইস্যুতে অবশ্য ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মাদক তৈরির এই উপকরণ প্রবাহ বন্ধে চীনের সহযোগিতা বাড়বে। এতে ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত ২০ শতাংশ শুল্ক কমানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা চীনের জন্য বড় স্বস্তি বয়ে আনতে পারে।

তবে প্রথম বাণিজ্যযুদ্ধ সময়েরপ্রথম ধাপ’ চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে তদন্ত, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি কিংবা প্রযুক্তি খাতের প্রতিযোগিতাএসব মৌলিক বিষয় এখনো আলোচনার বাইরে।

ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যোষ্ঠ পরামর্শক স্কট কেনেডির বলেন, ‘দুই দেশ এখন ছোটখাটো বাস্তব ইস্যুতে মনোযোগ দিচ্ছে, কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক কাঠামো নিরাপত্তা নীতির মতো বড় প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এগুলো হয়তো কখনোই সরাসরি আলোচনার টেবিলে আসবে না।

তাই ‍দুই দেশের বাণিজ্য যুদ্ধে সাময়িক বিরতি হয়তো বাজারে স্বস্তি এনেছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রচীন সম্পর্কের গভীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তাজনিত দ্বন্দ্ব অটুট রয়েই গেছে। যুক্তরাষ্ট্রচীন আবারও মুখোমুখি সংঘাতে গড়াবে কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতেই।

তথ্যসূত্র: ব্লুমবার্গ