সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় মানবাধিকারের অঙ্গীকার লঙ্ঘিত হচ্ছে : ৩০ নাগরিকের বিবৃতি

দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান মব সহিংসতা বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনাকে গভীর উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট ৩০ নাগরিক। তাঁদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল ভূমিকার কারণেই দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুরক্ষা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

Jun 24, 2025 - 21:27
সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় মানবাধিকারের অঙ্গীকার লঙ্ঘিত হচ্ছে : ৩০ নাগরিকের বিবৃতি
ছবি: সংগৃহীত

দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান মব সহিংসতা বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনাকে গভীর উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট ৩০ নাগরিক। তাঁদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল ভূমিকার কারণেই দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুরক্ষা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

আজ মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে দেশের ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার ওপর সংঘটিত মব ভায়োলেন্সের তীব্র নিন্দা জানান। তাঁরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে, নূরুল হুদার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোরও নিরপেক্ষ ও পেশাদার তদন্তের দাবি তোলেন তাঁরা। বিবৃতিতে বলা হয়, দোষী যে-ই হোক, তাঁর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি—এটাই ন্যায়ের পথ।

বিবৃতিতে বলা হয়, সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত রোববার রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার বাসায় ঢুকে একদল লোক তাঁকে বের করে আনেন এবং জুতার মালা পরিয়ে দেন। এর আগে একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। ঘটনাটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় এবং দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক এই উন্মত্ত সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে। উল্লিখিত উন্মত্ত সহিংসতার অপরাধ এবং পূর্বাপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অপরাধীদের প্রতি সরকারের নমনীয় ভূমিকায় আমরা তীব্র ক্ষোভ ও ধিক্কার জানাই। এই সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি সাবেক সিইসির বিরুদ্ধে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহিসহ ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি জানাই।

৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিক আজ এক যৌথ বিবৃতিতে মব সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদার ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ভিডিও ফুটেজসহ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গত ৮–১০ মাস ধরে একের পর এক মব ভায়োলেন্স ঘটলেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনানুগ পদক্ষেপের নজির নেই।

তাঁরা স্মরণ করিয়ে দেন, গুরুতর অভিযুক্ত হলেও বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষিত থাকা সংবিধান ও আন্তর্জাতিক আইনে নিশ্চিত। মব জাস্টিস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়; এটি রাষ্ট্রের আইনের শাসনের পরিপন্থী।

তিনটি দাবি উত্থাপন করা হয়—নূরুল হুদার ওপর হামলাকারীদের শনাক্ত করে যথাযথ আইনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার করতে হবে। মব সহিংসতা বন্ধে সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকে একযোগে সোচ্চার হতে হবে এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ নিতে হবে। তাঁরা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তায় দেশে ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার অঙ্গীকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী ৩০ জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে ছিলেন মানবাধিকার, উন্নয়ন, গবেষণা ও নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিরা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়ক খুশী কবির, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, নারীপক্ষের সদস্য শিরীন পারভীন হক, গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম এবং সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না।

এছাড়া রয়েছেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, শিশু অধিকারকর্মী ডা. নায়লা জামান খান, লেখক-গবেষক রেহনুমা আহমেদ, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বিএনডব্লিউএলএর নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, জোবাইদা নাসরীন, সুমাইয়া খায়ের, রোবায়েত ফেরদৌস ও তাসনীম সিরাজ মাহবুব।

স্বাক্ষরকারী অন্যদের মধ্যে রয়েছেন খায়রুল চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজীম, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান, মানবাধিকারকর্মী সাঈদ আহমেদ, গবেষক রেজানুর রহমান লেনিন, মানবাধিকারকর্মী দীপায়ন খীসা, বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ, বেলার (ভারপ্রাপ্ত) প্রধান নির্বাহী তাসলিমা ইসলাম এবং কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক হানা শামস আহমেদ।