চিকুনগুনিয়া ভাইরাস কী: চীনের মতো দেশগুলো কীভাবে এর বিরুদ্ধে লড়ছে?

মার্কিন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা পর্যটকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, কারণ একটি মশাবাহিত ভাইরাস এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং ভারত মহাসাগরের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ছে।

Aug 9, 2025 - 08:48
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস কী: চীনের মতো দেশগুলো কীভাবে এর বিরুদ্ধে লড়ছে?
ছবি: রয়টার্স

মার্কিন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা পর্যটকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, কারণ একটি মশাবাহিত ভাইরাস এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং ভারত মহাসাগরের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ছে।

ইউরোপীয় রোগ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (ইসিডিসি)- এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৬টি দেশে প্রায় লাখ ৪০ হাজার মানুষের চিকুনগুনিয়া ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে এবং ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

চীনের পরিস্থিতি

চীনে জুনের শেষ দিক থেকে প্রায় ,০০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, যার বেশিরভাগই হংকং-এর উত্তরে গুয়াংডং প্রদেশের ফোশান শহরে। এটি ২০০৮ সালে চীনে ভাইরাসটি শনাক্ত হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব।

চিকুনগুনিয়া ভাইরাস কী?

চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা সংক্রমিত অ্যাডিস অ্যাগিপ্টি মশার কামড়ে ছড়ায়। এই মশা ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার জিকা ভাইরাসও বহন করে।

চিকুনগুনিয়াশব্দটি তানজানিয়া মোজাম্বিকের কিমাকোন্ডে ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ 'বাঁকিয়ে দেওয়া' বা 'মোচড়ানো' — কারণ এতে আক্রান্ত রোগীরা প্রচণ্ড জয়েন্টের ব্যথায় কুঁকড়ে যান।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগী এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে ওঠে, তবে অনেক সময় জয়েন্টের ব্যথা মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর থাকতে পারে। এই ভাইরাসের কোনো প্রতিকার নেই, তবে মৃত্যু বিরল। গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকি বেশি নবজাতক, বয়স্ক হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের জন্য।

সংক্রমিত মশা সুস্থ মানুষকে কামড়ালে ভাইরাস সরাসরি রক্তে প্রবেশ করে। আবার কোনো সুস্থ মশা আক্রান্ত মানুষকে কামড়ালে তার রক্ত থেকে ভাইরাস নিয়ে সেটি অন্যদের মধ্যে ছড়াতে পারে।

বর্তমান প্রাদুর্ভাব কতটা গুরুতর?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ২০২৫ সালের শুরুতে প্রাদুর্ভাব শুরু হয় ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে, যেমন লা রিউনিয়ন, মায়োত মরিশাসে।

লা রিউনিয়নে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ৪৭,৫০০-এর বেশি সংক্রমণ ১২টি মৃত্যু হয়েছে, এবং দ্বীপজুড়ে সংক্রমণ উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। ইসিডিসি জানায়, ১৮ জুলাই পর্যন্ত সেখানে ৫৪,০০০-এর বেশি সংক্রমণ রেকর্ড করা হয়েছে। এটি ২০০৫২০০৬ সালের মহামারির পর সবচেয়ে গুরুতর প্রাদুর্ভাব। তখন ,৪৪,০০০ থেকে ,০০,০০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল।

ভাইরাসটি মাদাগাস্কার, সোমালিয়া কেনিয়াতেও ছড়িয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভারতের কিছু অংশে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। মুম্বাইয়ে জুলাই থেকে সংক্রমণ বেড়েছে।

ডব্লিউএইচও ইউরোপে আমদানি হওয়া সংক্রমণ নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে। মে থেকে ফ্রান্সে প্রায় ৮০০টি আমদানি হওয়া কেস শনাক্ত হয়েছে।

ইসিডিসি জানায়, আমেরিকা অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্রাজিলে ,৮৫,৫৫৩, বলিভিয়ায় ,৭২১, আর্জেন্টিনায় ,৮৩৬ এবং পেরুতে ৫৫টি সংক্রমণ হয়েছে।

চীনে ফোশান ছাড়াও গুয়াংডং প্রদেশের অন্তত ১২টি শহরে সংক্রমণ হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, জুলাইয়ে একটি 'আমদানি হওয়া কেস' থেকে স্থানীয় সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে আবহাওয়া গরম আর্দ্র হওয়ায় মশার বিস্তার বাড়ছে।

শনিবার হংকং- প্রথম সংক্রমণ নিশ্চিত হয়েছেএক ১২ বছর বয়সী ছেলে, যে ফোশান ভ্রমণের পর জ্বর, ্যাশ জয়েন্টের ব্যথায় আক্রান্ত হয়। এটি গত বছরে হংকং-এর প্রথম কেস।

চীন অন্যান্য দেশ কীভাবে মোকাবিলা করছে?

ব্লুমবার্গ জানায়, চীন দ্রুত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ড্রোন ব্যবহার করে মশার প্রজননস্থল খুঁজে ধ্বংস করা হচ্ছে। একই সময়ে বিজ্ঞানীরা বড় আকারের 'হাতি মশা' ছাড়ছেনযাদের লার্ভা ভাইরাস ছড়ানো ছোট মশাকে খেয়ে ফেলে।

বিবিসি জানায়, আক্রান্ত এলাকায় বাসিন্দাদের বাড়ি আশপাশের সব স্থির পানি (যেমন ফুলের টব, কফি মেশিন, খালি বোতল) সরাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। না মানলে প্রায় ১০,০০০ ইউয়ান (প্রায় ,৪০০ ডলার) জরিমানা বা গুরুতর ক্ষেত্রে ফৌজদারি অভিযোগ হতে পারে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, ফোশানে কিছু আক্রান্ত মানুষকে 'কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ডে' নেওয়া হচ্ছে, যেখানে তারা মশারি নেটের মধ্যে থাকে। কিছু রোগী জানান, তাদের নিজ খরচে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা হয়েছে।

লা রিউনিয়ন মায়োতে নজরদারি, মশা নিয়ন্ত্রণ এবং লক্ষ্যভিত্তিক টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্পেনের বাস্ক অঞ্চলে প্রতিরোধ প্রোটোকল চালু হয়েছে ফ্রান্স সীমান্তে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর। এর মধ্যে রয়েছে সীমান্ত শহরে নজরদারি বাড়ানো 'মসকুইটো অ্যালার্টঅ্যাপের মাধ্যমে রিপোর্ট দিতে উৎসাহিত করা।

প্রতিরোধ চিকিৎসা

স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখাই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এর মধ্যে রয়েছে

* লম্বা হাতা পায়জামা পরা

* মশা প্রতিরোধক ব্যবহার

* মশার প্রজননস্থল স্থির পানি সরানো

* ঘরের ভেতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বা মশারি ব্যবহার

এই ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি পান এবং ব্যথানাশক উপসর্গ কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে সিডিসি পরামর্শ দেয়, ডেঙ্গু না হওয়া পর্যন্ত এনএসএআইডি ধরনের ব্যথানাশক না নিতে, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

সূত্র: আল-জাজিরা