দল কাগজে-কলমে, অফিস ট্রাভেল এজেন্সিতে!

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করেছে মোট ১৪৭টি দল। দুই দফায় জমা দেওয়া আবেদনগুলোর তালিকা গতকাল সোমবার প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

Jun 25, 2025 - 03:16
দল কাগজে-কলমে, অফিস ট্রাভেল এজেন্সিতে!
ছবি: সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করেছে মোট ১৪৭টি দল। দুই দফায় জমা দেওয়া আবেদনগুলোর তালিকা গতকাল সোমবার প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

কিন্তু রাজধানীর পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন ও যাত্রাবাড়ীর কয়েকটি ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেল—এসব দলের ‘কার্যালয়’ আসলে কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ; বাস্তবে সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।

তথাকথিত এসব দলের নিবন্ধন আবেদনে দেওয়া ঠিকানাগুলোতে গিয়ে চোখে পড়ে বিস্ময়কর চিত্র। কোথাও তালাবদ্ধ, পরিত্যক্ত কক্ষ, কোথাও খাবারের হোটেল বা ট্রাভেল এজেন্সির সাইনবোর্ড। অনেক জায়গায় স্থানীয়রা এসব দলের নামই শোনেননি। কেউ আবার বলেন, “নেতাজি মাঝে মাঝে এখানে নাশতা করতে আসেন, ওটাই বোধ হয় অফিস!”

পুরানা পল্টনের ৫৪ নম্বর বাড়িকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়ে ‘বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দল’ ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। সরেজমিনে গিয়ে সেখানে কোনো সাইনবোর্ড বা রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। তৃতীয় তলা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ, দ্বিতীয় তলার রেস্তোরাঁ প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ, আর নিচে একটি খাবারের দোকান আছে মাত্র।

দলের চেয়ারম্যান মো. মিনহাজ প্রধান বলছেন, “তৃতীয় তলায় সংস্কার চলছে।” কিন্তু স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেই তলা বহুদিন ধরে তালাবদ্ধ। হোটেল ব্যবস্থাপক জানান, “নেতাজি মাঝে মাঝে এখানে নাশতা করতে আসেন, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক অফিস নেই।”

জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি’ নামের দল নয়াপল্টনের ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় তাদের কার্যালয় দেখিয়েছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুধু ট্রাভেল এজেন্সি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অফিস পাওয়া গেছে, কোনো রাজনৈতিক দলের চিহ্ন নেই।

দলটির চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান ফোনে জানান, “তাড়াহুড়োতে আল আমিন ট্রাভেলসকে অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছি, পরে ঠিকঠাক অফিস নেব।” অর্থাৎ ঠিকানা এখনো ভাড়া নেওয়া হয়নি, আবেদন আগেই জমা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ইউনাইটেড পার্টি’ ডিআইটি এক্সটেনশন রোডের ৫৩ নম্বর ভবনকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, পুরো ভবনে দলের কোনো অস্তিত্ব নেই।

দপ্তর সম্পাদক মো. মাসুদ মিয়া ফোনে কখনো বলেন, ষষ্ঠ তলায় অফিস তৈরির কাজ চলছে, আবার কখনো বলেন, একটি তালাবদ্ধ কক্ষই তাদের কার্যালয়। অথচ সেই তলায় ‘অভি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল’ নামের ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস সাজানোর প্রস্তুতি চলছে।

মাসুদের আত্মীয় পরিচয় দেওয়া জিসান জানান, সেখানে রাজনৈতিক দলের অফিস হবে কিনা তিনি জানেন না। সব মিলিয়ে, এটা দল না ট্রাভেল এজেন্সি তা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।

যাত্রাবাড়ীতে ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’ ১০২/৪, শহীদ ফারুক সড়কের পাঁচতলাকে কার্যালয় দেখিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সেখানে একটি একতলা আধাপাকা বাড়ি, যেখানে একটি পরিবার ভাড়া থাকে। সাইনবোর্ড বা রাজনৈতিক গন্ধ নেই।

চেয়ারম্যান মো. শাহজালালের নম্বরে ফোন ধরেন ‘শামীম’ নামের একজন, যিনি জানান নতুন ঠিকানার কথা কেউ জানে না। পরে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ৩১/সি নম্বরে হাজির হন, যেখানে তিনটি অনলাইন পত্রিকার অফিস রয়েছে।

কেন দুই ঠিকানা? দেলোয়ার বলেন, “আবেদনে তাড়াহুড়োতে ভুল হয়েছে, পরে ঠিক করা হবে।” যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দারা বলছেন, ও বাড়িটি ব্যক্তিগত, সেখানে কোনো রাজনৈতিক অফিস ছিল না।

পুরানা পল্টনের শাওন টাওয়ারের দশম তলায় ‘বাংলাদেশ আজাদী পার্টি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখানো হয়েছে। তবে সেখানে পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকলেও কোনো রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি নেই।

দলের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ফোনে জানান, “ধরে নিন, আমাদের অফিস এখানে আছে। অস্থায়ী কার্যালয় দিয়েছি।” তবে কোন কক্ষ ব্যবহার করছেন জানতে চাইলে অস্পষ্ট উত্তর দেন।

পুরানা পল্টন লেনের ৮৫/১/এ ঠিকানায় ‘বাংলাদেশ নাগরিক পার্টি’ ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে, কিন্তু সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

ভবনের তত্ত্বাবধায়ক আলমগীর হোসেন জানান, এখানে আগে ‘পিপলস পার্টি’র অফিস ছিল, তবে গত রমজানে মালিক তাদের বের করে দিয়েছেন, এরপর থেকে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল অফিস নেয়নি।

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নয়াপল্টনের ১১৬/১ বক্স কালভার্ট রোড ঠিকানায় তাদের কার্যালয় দেখিয়ে আবেদন করেছে, সেখানে ‘মদিনা ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে একটি দোকান রয়েছে।

জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি’ ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় কার্যালয় দেখিয়েছে, যেখানে ট্রাভেল এজেন্সি ও অফিস রয়েছে। চেয়ারম্যান মো. আবু তাহের জানান, নতুন অফিস সিদ্ধেশ্বরীতে, ঠিকানায় ভুল হয়েছে।

পুরানা পল্টনের প্রীতম জামান টাওয়ারের ১৫ তলায় ন্যাশনাল লেবার পার্টি ও জনতার অধিকার পার্টির কার্যালয় আছে। ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’ দল অধিকার পার্টির ছোট কক্ষটিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়েছে।

চেয়ারম্যান কে এম রকিবুল ইসলাম রিপন বলেন, তারা একসঙ্গে কাজ করছেন, শিগগির স্টিকার লাগানো হবে। জনতার অধিকার পার্টির চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম বলেন, রিপন এখানেই রাজনৈতিক কাজ করেন, এতে আপত্তি নেই।

পুরানা পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টসের গলির নূরজাহান শরীফ প্লাজায় ‘বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ’ নামে দলের ছোট কেন্দ্রীয় কার্যালয় রয়েছে। পাঁচটি চেয়ার, একটি বুকশেলফ এবং সোফাসহ সাদামাটা কক্ষে আশপাশে বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে।

দলের সভাপতি মো. আতিকুর রহমান রাজা জানান, ২০১১ সালে সামাজিক সংগঠন হিসেবে শুরু হলেও গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। বড় দলগুলো সাধারণ বেকারদের গুরুত্ব না দেওয়ায় এই দল গড়েছেন। চার মাস আগে কার্যালয় ভাড়া নিয়েছেন, আপাতত ছোট পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

নয়াপল্টনের ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারের ১৩তম তলায় ‘বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট পার্টি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় আছে। সেখানে দলটির নামফলক ও জাতীয় পতাকা থাকলেও অফিস তালাবদ্ধ এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম তেমন নেই। পাশের অফিসের লোকজন দলটির সভাপতি মো. আলমগীর হোসেনকে আইনজীবী হিসেবে চেনেন, তাঁর রাজনৈতিক দলের কথা জানেন না।

মো. আলমগীর হোসেন জানান, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর দলটি গঠন করেছেন এবং সব আইনি শর্ত পূরণ করে ইসিতে আবেদন করেছেন।

অন্যদিকে, পল্টন লেনের ৮৫/১ নম্বরে ‘বাংলাদেশ জনজোট পার্টি’র ছোট একটি কেন্দ্রীয় কার্যালয় রয়েছে। চেয়ার ও প্লাস্টিকের সেলফ দিয়ে সাজানো কক্ষে দলের নাম ও ইশতেহার লেখা ব্যানার টাঙ্গানো। চেয়ারম্যান মুজাম্মেল মিয়াজী বলেন, দল গঠন হয়েছে ২০২৪ সালের মার্চে, গত বছরের আগস্টের পর থেকে কার্যক্রম বাড়িয়েছে। তবে এখনও ইসির সব শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয়নি।