সংবাদমাধ্যমকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে এআই সার্চ

চ্যাটজিপিটির মতো জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রচলিত অনলাইন সার্চ ট্রাফিকে ব্যাপক কাটছাঁট করছে। এর ফলে সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলো পাঠক হারাচ্ছে, সেই সঙ্গে হারাচ্ছে বিজ্ঞাপন রাজস্ব। অথচ এটা তাদের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এমন এক সময়ে এই ধাক্কা এসেছে যখন শিল্পটি  বেঁচে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত।

Aug 4, 2025 - 19:08
সংবাদমাধ্যমকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে এআই সার্চ

চ্যাটজিপিটির মতো জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রচলিত অনলাইন সার্চ ট্রাফিকে ব্যাপক কাটছাঁট করছে। এর ফলে সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলো পাঠক হারাচ্ছে, সেই সঙ্গে হারাচ্ছে বিজ্ঞাপন রাজস্ব। অথচ এটা তাদের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এমন এক সময়ে এই ধাক্কা এসেছে যখন শিল্পটি  বেঁচে থাকার লড়াইয়ে লিপ্ত।

বোস্টন গ্লোব মিডিয়ার গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাট ক্যারোলিয়ান বলেন, 'আগামী তিন বা চার বছর প্রকাশকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে। এআই-র সারাংশভিত্তিক তথ্যের ঝড় আসছে, সবাই এর প্রভাবের মুখোমুখি হবে। প্রকাশকদের নিজেদের নিরাপত্তার আশ্রয় তৈরি করতে হবে, নাহলে তারা এই ঝড়ে উড়ে যাবে।'

সীমিত পরিমাণ তথ্যের ভিত্তিতে পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, গুগল সার্চে নিয়মিত আসা এআই-ভিত্তিক সারসংক্ষেপ ব্যবহারকারীদের মূল লেখায় ক্লিক করার আগ্রহ কমাচ্ছে।

এআইভিত্তিক সারসংক্ষেপ থাকলে ব্যবহারকারীরা সাধারণ সার্চের তুলনায় প্রস্তাবিত লিংকে আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম ক্লিক করেন।

বিজ্ঞাপন থেকে আয় ও সাবস্ক্রিপশন বৃদ্ধির জন্য ট্রাফিকের ওপর নির্ভরশীল অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য এটি একটি ভয়াবহ লোকসান।

নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন উইহবে বলেন, 'এই প্রবণতা আরও বাড়বে এবং খুব শিগগিরই আমরা একেবারে ভিন্নধর্মী ওয়েব দেখতে পাব।'

ইতিমধ্যে গুগল ও মেটার মতো বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অনলাইন সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন থেকে আয় ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। ফলে প্রকাশকদের এখন সাবস্ক্রিপশনের ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে।

কিন্তু উইহবে মনে করেন, সাবস্ক্রিপশনও ট্রাফিকের ওপর নির্ভর করে, আর কেবল সাবস্ক্রাইবারের আয়ে বড় সংবাদ সংস্থাগুলো টিকে থাকতে পারবে না।

বোস্টন গ্লোব গ্রুপ ইতিমধ্যেই চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে কিছু সাবস্ক্রাইবার পাচ্ছে, যেটা নতুন পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর একটা পথ বলে জানান ক্যারোলিয়ান।

তবে 'এই সংখ্যা এখনো খুবই সামান্য অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের তুলনায়, এমনকি ছোট সার্চ ইঞ্জিনগুলোর তুলনায়ও।'

অন্যদিকে পারপ্লেক্সিটির মতো অন্যান্য এআই–ভিত্তিক টুল থেকে নতুন সাবস্ক্রিপশনের পরিমাণ আরও কম বলে জানান ক্যারোলিয়ান।

অনেকে এই পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী মনে করছেন। তাই সংবাদ প্রকাশনার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের (জিইও) ব্যবহার শুরু করেছে। এটি এখন পুরোনো এসইওর জায়গা নিচ্ছে।

এআই মডেলের উপযোগী করার জন্য কনটেন্টে স্পষ্ট লেবেল, পরিষ্কার গঠন ও সহজ ভাষা ব্যবহার করতে হয়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রেডিটের মতো ফোরামে সক্রিয় উপস্থিতিও জরুরি। এআই কোম্পানিগুলো এসব নিয়মিত স্ক্যান করে।

তবে একটি মৌলিক প্রশ্ন রয়েই যায়। অপটিমাইজেশন (সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়া) স্টার্টআপ অটারলিএআইয়ের প্রধান নির্বাহী টমাস পেহাম প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আপনার কি ওপেনএআইয়ের স্বয়ংক্রিয় স্ক্যানিং বটকে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট স্ক্যান করার অনুমতি দেওয়া উচিত?’

বড় বড় এআই কোম্পানির আগ্রাসী তথ্য সংগ্রহের ফলে অনেক সংবাদমাধ্যম এখন তাদের কনটেন্ট এআই ক্রলারের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে।

নিউজ/মিডিয়া অ্যালায়েন্সের প্রধান ড্যানিয়েল কফি বলেন, 'আমরা শুধু চাই, যারা আমাদের কনটেন্ট ব্যবহার করছে, তারা যেন তার জন্য ন্যায্য মূল্য দেয়।'

এই বিষয়ে কিছু অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। যেমন, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও অ্যামাজন, গুগল ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এবং মিস্ট্রাল ও এজেন্স ফ্রান্স-প্রেস-এর মধ্যে কনটেন্ট লাইসেন্সিং চুক্তি হয়েছে।

তবে সমস্যার পুরো সমাধান এখনো হয়নি। বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের করা ঐতিহাসিক মামলা, যা ওপেনএআই এবং মাইক্রোসফটের বিরুদ্ধে চলছে—তা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

প্রকাশকদের এখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে—এআই ক্রলার ব্লক করলে কনটেন্ট সুরক্ষিত থাকবে, কিন্তু সম্ভাব্য নতুন পাঠকদের কাছে তা পৌঁছানো কঠিন হবে।

এই বাস্তবতায় অনেক সংবাদমাধ্যম আবার কনটেন্ট উন্মুক্ত করে দিচ্ছে, বলছেন অপ্টিমাইজেশন স্টার্টআপ অটেরলি-এআই-এর সিইও থমাস পেহ্যাম। তবে কনটেন্ট উন্মুক্ত করলেই যে ভালো ফল মিলবে, তা নিশ্চিত নয়।

অটেরলি-এআই-এর তথ্য বলছে, চ্যাটজিপিটিতে যে রেফারেন্সগুলো দেখানো হয়, তার মাত্র ২৯% সংবাদমাধ্যম থেকে নেয়া; অন্যদিকে কর্পোরেট ওয়েবসাইটের অংশ ৩৬%।

আর গুগল যেখানে নির্ভরযোগ্য সূত্রকে বেশি গুরুত্ব দেয়, চ্যাটজিপিটিতে সেটা দেখা যায় না, বলেন পেহ্যাম।

রয়টার্স ইন্সটিটিউট-এর ২০২৫ সালের ডিজিটাল নিউজ রিপোর্ট অনুযায়ী, এখন ২৫ বছরের নিচে প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ খবর জানতে জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করছে।

কিন্তু এআই কনটেন্টের উৎস বা নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। ফলে পাঠকরা বিভ্রান্ত হতে পারেন—যেমনটা এক সময় সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও হয়েছিল।

বোস্টন গ্লোব মিডিয়ার গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যাট ক্যারোলিয়ান বলেন, 'শেষ পর্যন্ত কাউকে না কাউকে রিপোর্টিং করতেই হবে। মূল সাংবাদিকতা না থাকলে এআই-এর সারসংক্ষেপ বলারও কিছু থাকবে না।'

এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই হয়তো গুগল এখন কিছু সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলছে, যাতে তাদের জেনারেটিভ এআই ফিচারে নির্ভরযোগ্য কনটেন্ট ব্যবহার করা যায়। এটা ভবিষ্যতের পথ হতে পারে।

নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন উইহবে আশাবাদী, 'আমার বিশ্বাস, প্ল্যাটফর্মগুলো খুব শিগগিরই বুঝতে পারবে, তারা সংবাদমাধ্যম ছাড়া টিকতে পারবে না।' তবে সেই উপলব্ধি যথাসময়ে আসবে কিনা, তা এখনও বলা যাচ্ছে না।

সূত্র: এপি